(এক)
শিবচরণ বাবু চতুর্থ ঘন্টায় অষ্টম শ্রেণির কক্ষে এসে চেয়ারে বসে আনুমানিক দুই মিনিট অপেক্ষা করে হাজিরা খাতা খুললেন। হাজিরা সংক্রান্ত ব্যাপারে শিবচরণ বাবুর বাড়তি একটা নিয়ম আছে যা অন্য শিক্ষকদের নেই। নিয়মটা হলো- তিনি অফিস কক্ষ থেকে শ্রেণি কক্ষে ঢোকার দুই মিনিটের মধ্যে সব মেয়েদেরকে তাদের কমন রুম থেকে শ্রেণিকক্ষে ঢুকতে হবে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে সময়টা ত্রিশ সেকেন্ড বর্ধিত করা হয়, তবে তা সব সময় না। যে ছাত্রী নির্ধারিত সময়ের মধ্যে হাজির হতে না পারে তার জন্য পনের মিনিট দাঁড়িয়ে থাকার পূর্ব ঘোষিত শাস্তিটি বহাল রাখা হয়।
চতুর্থ ঘন্টায় অষ্টম শ্রেণির বাংলা বিষয় পড়ানো হয়। তিনি এ সময়টাতে বিদেশী শব্দ ব্যবহার না করার জন্য যথাসম্ভব চেষ্টা করেন। আর তাই হাজিরা খাতার ক্রমিক নম্বরটাও তিনি বাংলাতেই বলেন। তিনি খাতা খুলে ক্রমিক নম্বর বলে হাজিরা মিলিয়ে উপস্থিতি নিশ্চিত করতে থাকলেন। হাজিরা খাতার উপস্থিতি মিলানো কিংবা খাতায় স্বাক্ষর প্রদানের সময় ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ শিবচরণ বাবুর হাতের দিকে তাকিয়ে থাকে। তার ডান হাতের তর্জনী আঙ্গুল না থাকার কারণে তিনি স্বাভাবিকভাবে কলম ধরতে পারেন না। বৃদ্ধ এবং মধ্যমা আঙ্গুলের সাহায্যে কলম ধরেন, তাতে অবশ্য কাজের তেমন কোনো অসুবিধা হয় না। তার এই আঙ্গুল হারানোর একটা ঘটনা প্রচলিত আছে তার পরিচিত মহলে। যুবক বয়সে এই আঙ্গুলটি ধারালো অস্ত্রে কাটা পড়েছিল। তবে কথাগুলো অস্ত্র সম্পর্কিত হলেও এর পেছনে কোনো নিশংস কাহিনী নেই। এটাকে একটা দুর্ঘটনাও বলা যেতে পারে। তিনি যখন বিএ পাশ করেছিলেন তখন তার নিজ এলাকায় আর কেউ এতবড় ডিগ্রী অর্জন করতে পারেনি। এই খুশিতে তার বাবা কানাই চন্দ্র ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি পাঠা বলি দিবেন। ঘোষণামতে ধুমধামের সাথে অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হলো। সকল কাজ প্রস্তুতি শেষে পাঠাকে জায়গা মত ঠিকঠাক রেখে তার গলার সঠিক স্থানে অস্ত্র চালনার জন্য শিবচরণ বাবু অস্ত্রধারী লোকটিকে বুঝিয়ে দিচ্ছিলেন। লোকটা অস্ত্র উচু করে যথারীতি প্রস্তুত। শিবচরণ বাবু ব্যাপারটা আরো ভালোভাবে বুঝানোর সুবিধার্থে তিনি সঠিক স্থান চিহ্নিত করার জন্য আবার যেইনা ওখানে তর্জনী আঙ্গুল রাখলেন, অমনি উপর থেকে গতিময় অস্ত্রটা তার তর্জনী আঙ্গুলের মধ্যভাগসহ ছাগলের মুন্ডু দ্বিখন্ডিত করে দিল। অস্ত্রধারী লোকটা বুঝতে পারেনি যে, শিবচরণ বাবু পুনরায় এখানে হাত রাখবেন। এই ঘটনার পর থেকেই শিবচরণ বাবু তার তর্জনী আঙ্গুলের কাজগুলোর দায়িত্ব পার্শ্ববর্তী আঙ্গুলের উপর দিয়েছেন। তর্জনী আঙ্গুল বিয়োগের পর বেশ কিছুদিন সমস্যাবোধ হলেও আস্তে আস্তে সয়ে গেছে।
হাজিরা শেষ করে অন্যদিনের মত আজও তিনি মেয়েদের মধ্য থেকে পড়া ধরা শুরু করলেন। মেয়েদের পড়া নেয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত তিনি ছেলেদের পড়া ধরেন না। মেয়েদের পড়া নিতে নিতে সময় শেষ হয়ে আসলে সেদিন আর ছেলেদের পড়া ধরা হয় না। সেদিন বেঁচে যায় পড়া না পারা ছেলেগুলো। নিয়ম সংক্রান্ত কারণে এই বেঁচে যাওয়ার সুযোগটা মেয়েদের ক্ষেত্রে হয় না কখনো। এই রীতি ছাড়া অন্যদিক থেকেও মেয়েদেরকে একটু কড়া নজরে রাখার অভিযোগ রয়েছে শিবচরণ বাবুর বিরদ্ধে। ছাত্রী মহলে কথিত আছে তিনি ছেলেদের তুলনায় মেয়েদেরকেই বেশি শাস্তি দেন। মেয়েদের প্রতি এমন আচারণের কি কারণ আছে সে সম্পর্কিত একটা কাহিনী প্রচলিত আছে তার ছাত্র-ছাত্রী মহলে। জানা যায় ছাত্রজীবনে তিনি একটি মেয়েকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন। তাদের দু'জনার সম্পর্কটাও বেশ শক্ত হয়েছিল। কিন্তু শেষমেশ মেয়েটা তাকে বিয়ে করতে সম্মত হয়নি। সেই থেকে মেয়েদের প্রতি শিবচরণ বাবুর এমন বিরূপ মনোভাব। অবশ্য এ ঘটনার নির্ভরযোগ্য কোন দলিল নেই, এবং এটা শিবচরণ বাবু কর্তৃক স্বীকৃতও না, তারপরও কথাগুলো মুখরোচক হওয়ায় এই কথাগুলোই বছরে বছরে সিনিয়র ছাত্র-ছাত্রীরা জুনিয়রদের জানিয়ে যাচ্ছে।
কয়েকজন ছাত্রীর পড়া শোনার পর তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন আজ আর কারো পড়া না শুনে নতুন করে পড়া বুঝিয়ে দেবেন। আজ ক্লাসে মন বসতে চাচ্ছে না। শরীরটা বেশ ক্লান্ত মনে হচ্ছে। আসার পথে সাইকেলটাতে সমস্যা হওয়ায় অনেকটা পথ হেঁটে আসতে হয়েছে। তিনি প্রতিদিন সিইকেলযোগে পাঁচ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে স্কুলে আসেন। পথে সাইকেল মেরামতের কোন দোকান নেই। ফলে পথিমধ্যে সমস্যা হওয়ায় বাকী পথটুকু সাইকেল ঠেলে হেঁটে হেঁটে আসতে হয়েছে। সাইকেলটা বেশ পুরনো হয়ে গেছে। অনেকেই বলেছে নতুন একটা সাইকেল কিনতে, কিন্তু পুরনো সাইকেলটার উপর দীর্ঘদিনের মায়া পড়ে যাওয়ায় তিনি এটা ছাড়তে পারেন না। পরিচিতজনদের অনেকেই বলেছে "সাইকেলটার অনেক বয়স হয়েছে, এটা আর কত চালাবেন? এবার ওকে একটু অবসর দেন, নতুন একটা সাইকেল কিনুন, তাতে আপনারও কষ্ট কম হবে।" শিবচরণ বাবু নিজেও খেয়াল করেছেন সাইকেলটা তার নিজস্ব রং হারিয়েছে অনেক বছর আগে। বারকয়েক রংও করিয়েছিলেন, কিন্তু সেটাও একসময় মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে। কোথাও কোথাও মরিচা চিরস্থায়ীভাবে আসন করে নিয়েছে। মাস কয়েক আগে শিবচরণ বাবু সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন আরেকটা সাইকেল কিনবেন কিন্তু এখন সেটার আর প্রয়োজন মনে হচ্ছে না। কারণ সাইকেলটার অবসর গ্রহণের আগেই তার শিক্ষকতা জীবনের অবসর গ্রহণের ঘোষণা চলে এসেছে। কর্তৃপক্ষের ঘোষণামতে তিনি আর মাত্র এক মাস এই স্কুলে শিক্ষকতা করতে পারবেন, তারপর অবসর। তার হিসেব মতে এখনও চার বছর সময় পাবার কথা, কিন্তু বিশেষ কারণে তার সময় ঘনিয়ে এসেছে।
তিনি ছাত্র-ছাত্রীদেরকে নতুন পড়া বুঝিয়ে দিয়ে শ্রেণিকক্ষ থেকে বের হন। পিছে পিছে ছাত্রীরা কমন রুমের দিকে যেতে থাকে।
(দুই)
শিবচরণ বাবুর স্ত্রী বিমলা বালা যখন শুনেছিলেন শারীরিক দুর্বলতার কারণে তার স্বামীর চাকুরির মেয়াদ কমিয়ে আনা হয়েছে তখন তার মনটা যথেষ্ট খারাপ হয়ে গিয়েছিল। মাঝে মধ্যে একটু আধটু জ্বর ছাড়া শিবচরণ বাবুর তেমন বড় ধরনের কোন সমস্যা বিমলা বালার সামনে ধরা পড়েনি। মাস তিনেক আগে একবার ঠান্ডা লেগে সর্দি জ্বর হয়েছিল। সেটাও মোটামুটি ভালো হয়ে গেছে। তাই স্বামীর শারীরিক সমস্যার কারণে চাকুরি ছাড়ার ব্যাপারটা বেশ ভাবিয়ে তোলে তাকে। চাকুরি শেষ অবধি না গেলে পেনশনের টাকা নিয়ে অনেক সময় ঝামেলা পোহাতে হয়। তবে ম্যানেজিং কমিটির পক্ষ থেকে পেনশনের টাকা পাওয়ার ব্যাপারটা নিশ্চিত করা হয়েছে।
শিবচরণ বাবু প্রতিদিন তার সাইকেলটা বাড়ির বাইরে আনার পর চালাতে শুরু করেন। বিমলা বালা তার সাথে বাড়ির বাইরে আসার প্রয়োজন মনে করেন না, তবে স্কুল থেকে ঐ খবর আসার পর থেকে প্রায় প্রতিদিনই ঘরের বাইরের দরজা পর্যন্ত তিনি স্বামীর সাথে আসেন এবং রাস্তায় সাবধানে যেতে বলেন।
স্কুল থেকে অবসরের কথা জানানোর আগে স্কুলের প্রায় সকল শিক্ষক নিয়মিত তার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করতেন, স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে বলতেন। তিনি তাদের অভয় দিয়ে বলতেন- “সামান্য সর্দিজ্বর হয়েছে, তেমন কোনো সমস্যা নেই, দু'একদিনের মধ্যেই ঠিক হয়ে যাবে”। ঠিক হয়েও গিয়েছিলেন তিনি, কিন্তু শিক্ষকদের সেই জিজ্ঞাসাবাদ এবং স্বাস্থ্য সচেতনতার পরামর্শ দেয়া আর বন্ধ হয়নি। কেউ কেউ জিজ্ঞেস করেন- “স্যার, আপনাকে বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছে। শরীর ঠিক আছে তো?” তাদের কথা শুনে শিবচরণ বাবু তার শরীরে সমস্যা খোঁজার চেষ্টা করেও কোন সমস্যা খুঁজে পাননি। এরই মধ্যে একদিন প্রধান শিক্ষক তার রুমে ডেকে নিয়ে বললেন- “আপনাকে ইদনিং বেশ ক্লান্ত দেখায়, বয়স হয়েছে, বেশি রোদে-টোদে যাওয়া দরকার নেই। স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিবেন”।
প্রধান শিক্ষকের কথাটা শিবচরণ বাবুর মাথায় ঘুরপাক খেতে থাকে। সেই রেশ ধরেই এক সময় তার মাথাটা কেমন যেন চক্কর দিল, তিনি মাথাঘুরে পড়ে গেলেন। সঙ্গে সঙ্গে ছাত্র এবং শিক্ষকেরা মিলে মাথায় পানি দিয়ে প্রাথমিক চিকিৎসায় তাকে সুস্থ করে বাড়িতে পাঠালেন।
শিবচরণ বাবু মোটামুটি সুস্থ হলে তার স্ত্রী বিমলা বালা তার মাথা ঘোরার কারণ জানতে চাইলে তিনি উল্লেখযোগ্য কোনো কারণ তুলে ধরতে পারলেন না, তবে তার প্রতি স্কুলের শিক্ষকদের স্বাস্থ্য সম্পর্কিত পরামর্শের কথা এবং প্রধানের শিক্ষকের সেদিনের সতর্কতামূলক কথাগুলো বিমলা বালাকে জানালেন। কথাগুলো শুনে বিমলা বালা বেশ চিন্তিত হলেন। সেদিন বিকেলেই তিনি শিবচরণ বাবুকে থানা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিয়ে গেলেন। ডাক্তার দেখে-শুনে যে রিপোর্ট দিলেন সেটাকে সন্তোষজনকই বলা যায়। ডাক্তার জানালেন, শিবচরণ বাবুর তেমন কোনো সমস্যা নেই, সম্ভবত দুঃশ্চিন্তা করার জন্য এমনটা হয়েছে। তিনি শিবচরণ বাবুকে দুঃচিন্তা না করা, সময়মত খাওয়া-দাওয়া করা ও ঠিকমত ঘুমানোর পরামর্শ দিলেন।
শিক্ষকতার দীর্ঘ সময়টাতে শিবচরণ বাবুর স্কুল কামাই দেয়ার তেমন কোনো নজির নেই। তাই ডাক্তারের কথা রাখতেই কোনো রকমে দুই দিন বিশ্রাম নিয়ে আবার স্কুলে হাজির হলেন। সেদিন প্রধান শিক্ষক তাকে ডেকে বললেন- আপনি ইচ্ছে করলে আরো কিছুদিন বিশ্রাম নিতে পারেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে স্কুলে আসার দরকার নেই। প্রধান শিক্ষকের কথা শুনে শিবচরণ বাবু বেশ অবাকই হয়েছিলেন। কারণ প্রধান শিক্ষক সচরাচর তার সাথে এমন সুন্দর করে কথা বলেন না। তিনি বেশ ধমকের শুরেই কথা বলেন। জীবনে অনেকবারই শিবচরণ বাবু প্রধান শিক্ষকের কাছে ধমক খেয়েছেন। বেশিরভাগ ধমকগুলোই খেয়েছেন কথা চেপে না রাখার কারণে। শিবচরণ বাবু নিজেও জানেন তার একটা দুর্বলতা আছে, তিনি কথা চেপে রাখতে পারেন না। একদিন ক্লাসে কথাপ্রসঙ্গে তিনি একটি ঝামেলাযুক্ত কথা বলে ফেলেছিলেন। কোনো এক সূত্র ধরে এক ছাত্র বলেছিল- "আমাদের স্কুলের পিয়ন চাচা পিয়ন হয়েও পাকা ঘর তৈরী করেছেন অথচ আমাদের হেড স্যার এখনো তার ঘরটা পাকা করতে পারেননি। এমন একজন সৎ ও নীতিবান প্রধান শিক্ষক পেয়ে আমরা গর্বিত।" ছাত্রের গর্ববোধ করা কথাটার সাথে তিনি তাল মেলাতে পারেননি। মুখফসকে বলে ফেলেছিলেন- “পাকা বাড়ি করার মত টাকা যে তার নেই তা নয়, তিনি ইচ্ছে করেই করেন না। কয়েকটা পাকা বাড়ী করার মত টাকা তার সেভিং একাউন্টে জমা আছে”। শিবচরণ বাবুর এ কথাটা ছড়িয়ে পড়ে কানে কানে। এমনকি একসময় তা প্রধান শিক্ষকের কানেও যায়। খবরটা শুনে প্রধান শিক্ষক শিবচরণ বাবুকে রুমে ডেকে এ ধররের অপপ্রচার না করার জন্য কঠোরভাবে নির্দেশ দিলেন। প্রধান শিক্ষকের এমন অগ্নিমুর্তি দেখে শিবচরণ বাবু রীতিমত ঘাবড়ে গেলেন। তবে কথাটা যে মিথ্যে বলেননি এবং তা স্বয়ং প্রধান শিক্ষকেরই চাচাত ভাইয়ের কাছ থেকে শুনেছেন সেটা বোঝাতে রেফরেন্স স্বরুপ তার নামটা পেশ করেও লাভ হয়নি বরং এ কথায় প্রধান শিক্ষক আরো রাগান্বিত হয়ে বললেন যে, ভবিষ্যতে যেন হিসেব করেই কথাবার্তা বলেন।
প্রধান শিক্ষকের সেই নির্দেশটুকু ইচ্ছে থাকা সত্তেও তিনি যথাযথভাবে পালন করতে পারেননি। স্কুলের সীমানা প্রাচীর বানানোর সময় যে সত্তর হাজার টাকার দুর্নীতি হয়েছে সেটাও তিনি চেপে রাখতে পারেননি। এমনকি স্কুলের ম্যানেজিং কমিটির সভাপতির ছেলে ক্লাস সিক্সের ফাইনাল পরীক্ষায় ইংরেজিতে ফেল করার পর সভাপতির আদেশেই তাকে পাশ করিয়ে দিয়েছেন সেটাও গোপন রাখতে পারেননি। আর এসব কারণে প্রতিবারই তিনি প্রধান শিক্ষকের রুমে গিয়ে কঠোর মেজাজের মুখোমুখি হয়েছেন। সে কারণেই হঠাৎ তার বিশ্রামের ব্যাপারে প্রধান শিক্ষকের এমন সোনায় সোহাগা আলাপচারিতায় শিবচরণ বাবু অবাক না হয়ে পারেননি। তিনি প্রধান শিক্ষককে জানালেন যে, তিনি সুস্থ আছেন এবং প্রতিদিন স্কুলে আসতে এবং ঠিকঠাকভাবে ক্লাস নিতেও পারবেন, কোনো অসুবিধা হবে না।
তারপর থেকে প্রতিদিনই তিনি স্কুলে আসতে থাকলেন। প্রায় সকল শিক্ষকই তার শারীরিক অবস্থার কথা জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কেউ কেউ আবার আগের মত বলেন- “স্যার, আপনাকে বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছে। শরীর ঠিক আছে তো?” তিনি নিজের কাছে তেমন কোনোরকম অসুস্থবোধ না করলেও তাদের কথা শুনে ভাবেন তিনি আসলেই বোধহয় সুস্থ নন। এমনি করেই দিন চলতে থাকে। এরই মধ্যে গত মাসের মাঝামাঝি সময়ে ম্যানেজিং কমিটির ডাকা এক জরুরী সভায় সবার সম্মতিতে সিদ্ধান্ত গৃহীত হয় যে, শারীরিক সমস্যা থাকার কারণে দুই মাস পর শিবচরণ বাবু অবসর গ্রহণ করবেন।
(তিন)
এলাকার অনেকেই জেনে গেছে যে, রায়পুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের সুনামধন্য শিক্ষক শিবচরণ বাবু অবসরে যাচ্ছেন। তবে এই জানাজানিটা সবার কাছে একইরকম না, এটাকে কয়েকটা ক্যাটাগরিতে ভাগ করা যেতে পারে। যেমন- যারা এলকার সাধারণ জনগণ তারা জানে শিবচরণ বাবুর বয়স হয়েছে, চাকুরির মেয়াদও শেষ হয়েছে সেকারণেই তিনি অবসরে যাচ্ছেন। শিবচরণ বাবুর মোটামুটি কাছের মানুষ এবং তার ছাত্র-ছাত্রীদের একাংশ জানে তার শারীরিক সমস্যার কারণে মেয়াদ থাকা সত্তেও তিনি অবসরে যাচ্ছেন। আর বিদ্যালয়ের ম্যানেজিং কমিটির মধ্যে অন্তুর্ভুক্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিবর্গ এবং শিক্ষকমহলের একাংশ জানেন শিবচরণ বাবু প্রধান শিক্ষক এবং কমিটির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করার কারণেই কমিটি তাকে শারীরিক দুর্বলতার কারণ দেখিয়ে অবসরে যাবার ব্যবস্থা করেছে। বিদ্যালয়ের সহকারী প্রধান শিক্ষক আমজাদুল হক সাহেব শেষ ক্যাটাগরিতে পড়ার কারণে তিনি জানেন যে, শিবচরণ বাবুকে চক্রান্ত করার দায়েই স্কুল থেকে বিদায় গ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। এলাকাবাসীর আলোচনা-সমালোচনায় যাতে ষড়যন্ত্রের অদ্যপান্ত নিয়ে বাড়তি শিকড় বিস্তৃত না হয় জন্য এই পন্থা বেছে নেয়া হয়েছে। আমজাদুল হক সাহেব স্কুল থেকে ১৫ দিনের ছুটি নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন তার মায়ের উন্নত চিকিৎসার জন্য। দেশে ফেরার পরেই এসব শুনলেন। শুনে বেশ মর্মাহত হলেন। বিশ/পাঁচশ দিন ধরে তিনি সেই ষড়যন্ত্রের বিষয়বস্তুসহ শিবচরণ বাবুর অবসর সম্পর্কিত যাবতীয় বিষয়ে খোঁজ খবর নিলেন। খোঁজ খবর নেয়ার পর তিনি যেটা দেখতে পেলেন তাতে কমিটির ঐ চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের সাথে একমত হতে পারলেন না। তাই তিনি চিন্তা করলেন বিষয়টি নিয়ে প্রধান শিক্ষকের সাথে আলোচনা করবেন।
পর দিন সকালে প্রধান শিক্ষকের রুমের গেটে দাঁড়িয়ে আমজাদুল হক সাহেব ভিতরে ঢোকার অনুমতি চাইলেন। প্রধান শিক্ষক চশমার উপর দিয়ে আজকের পেপারটায় চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন। দরজার দিকে তাকিয়ে আমজাদুল হক সাহেবকে দেখে ইশারায় অনুমতি দিলেন। হক সাহেব ভিতরে এসে একটা চেয়ার টেনে বসলেন।
- কোনো সমস্যা হক সাহেব?
- স্যার, ক'টা গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে চাচ্ছিলাম।
- কোন ব্যাপারে ?
- শিবচরণ বাবুর ব্যাপারে।
- বলুন কি বলতে চান।
- স্যার, শিবচরণ বাবুকে তো আমরা অনেক বছর ধরেই চিনি-জানি। তিনি সরল মনের মানুষ। তিনি সোজা-সাপটা কথা বলে থাকেন। তিনি আপনার সম্পর্কে বা স্কুলের প্রচীর নির্মাণ সম্পর্কে অথবা স্কুল কমিটির সভাপতি সম্পর্কে যেসব কথা বলেছেন তা নিতান্তই কথার প্রেক্ষিতে বলে ফেলেছেন। এর পেছনে কোনো প্রকার চক্রান্ত বা হীন উদ্দেশ্য নেই। তাছাড়া এত বছর ধরে আমরা তাকে দেখছি, কোনো সময় তো এ ধরনের খারাপ কোনো কার্যকলাপ করতে দেখিনি।
প্রধান শিক্ষক পেপারটা সরিয়ে টেবিলের উপর রেখে বললেন- “তিনি সরল মনেই বলেন আর চক্রান্তমূলকভাবেই বলেন কথাগুলো আমার এবং কমিটির ভাবমুর্তি ক্ষুন্ন করছে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না। হিসাব-কিতাব করে কথা বলার মত বুঝশক্তি যদি তার মধ্যে না থাকে তাহলে তিনি কেমন সুস্থ মানুষ? আপনার যদি তাকে শারীরিক সমস্যাগ্রস্ত ভাবতে আপত্তি থাকে তাহলে তাকে মানসিক সমস্যাগ্রস্ত ধরে নিতে পারেন। আর এটা নিশ্চয় জানেন কোনো মানসিক সমস্যাগ্রস্ত মানুষ অন্তত স্কুলের শিক্ষক হতে পরেন না।”
আমজাদুল হক সাহেব মনোযোগ দিয়ে প্রধান শিক্ষকের কথাগুলো শুনলেন। ওনার কথা শুনে মনে হচ্ছে ঐ সিদ্ধান্তের কোনো নড়চড় হবার সম্ভাবনা নেই। হক সাহেব কিছুক্ষণ চুপ থেকে উঠে দাঁড়ালেন।
- আমি এখন আসি স্যার।
- ঠিক আছে যান, এটা নিয়ে অযথা কারো সাথে আলোচনা করার দরকার নেই।
আমজাদুল হক সাহেব মাথা নেড়ে ইতিবাচক রায় দিয়ে আস্তে আস্তে রুম ত্যাগ করলেন।
(চার)
রায়পুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের মাঠে প্রচুর লোকের সমাগম। শিবচরণ বাবুর বিদায় সংবর্ধনায় নানা শ্রেণির মানুষ যোগ দিয়েছে। আজ শিবচরণ বাবুর মনটা বেশ ভালো লাগছে। মঞ্চের একটি বিশেষ চেয়ারে তিনি বসে আছেন। একাধিক ফুলের মালা তার গলায় শোভা পাচ্ছে। ছাত্র-ছাত্রীরা অশ্রুসিক্ত চোখে প্রিয় শিক্ষকের গলায় মালা পরিয়ে দিয়েছে। মালা গ্রহণের সময় শিবচরণ বাবুর মনটা খুব খুশি খুশি লাগছিল। সবাই তাকে এত ভালোবাসে তা তিনি কখনো ভাবেননি। তবে এই খুশির মাঝেও তার মনে একটা সংশয় তৈরি হয়েছে। তিনি বুঝতে পারছেন না এমন দিনে তার মনটা কেমন হওয়া উচিত? এ সময় তার কি হাসি খুশি থাকা উচিত নাকি গম্ভীর প্রকৃতির থাকা উচিত? তার মনে হচ্ছে এর আগে এ ধরনের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ঐ কেন্দ্রীয় মানুষটার ভাবমূর্তি দেখে রাখার দরকার ছিল। তাহলে আজ সেটা কাজে লাগতো।
আমজাদুল হক সাহেব শিবচরণ বাবুর পাশের চেয়ারটাতে বসেছেন। তিনি বিষয়টা এখনও মেনে নিতে পারছেন না। শিবচরণ বাবু সরল মনের মানুষ না হলে অসুস্থতার কথা বলে তাকে সরানো অতটা সহজ ছিল না। শিবচরণ বাবুর এমন পরিস্থিতি দেখে একটা পুরানো গল্পের কথা মনে গেল আমজাদুল হকের- এক লোক একটা ছাগলছানা কোলো নিয়ে যচ্ছিলো। পথিমধ্যে তিন বাটপাড় তাকে দেখে বুদ্ধি আটলো। তারপর তাদের মধ্যে একজন লোকটার সামনে এসে বললো- "চাচা মিয়া, কুকুরের বাচ্চা কোলে নিয়ে কই যান?" কথাটা শুনে সেই লোকটি জানালো যে, এটা কুকুর ছানা নয়, ছাগল ছানা। কিন্তু বাটপাড় লোকটি আবার বললো- "না, এটা কুকুর ছানাই"। লোকটা তাতে কান না দিয়ে এগিয়ে চললো। কিছুদূর এগিয়ে যাওয়ার পর আরেক জন সামনে এসে একই কথা বললো- "ভাই কুকুরের বাচ্ছা কোলে নিয়ে কই যান?" লোকটি এবার কিছুটা ইতস্তত করে বললো- "এটা তো ছাগাল ছানা"। কিন্তু দ্বিতীয় বাটপাড় জানালো যে, সে ভুল দেখছে একটা কুকুর ছানাই। এ কথা শুনে লোকটি দ্বিধার মধ্যে পড়ে গেল, সে কি আসলেই ভুল দেখছে? পর পর দুইটা লোক তো ভুল দেখতে পারে না। আবার কিছুদূর যাওয়ার পর তাদেরই আরেকজন সামনে এসে সেই এই কথা বললো। এবার লোকটির মনে হলো অন্য মানুষেরা ঠিক কথাই বলছে, তার নিজেরই বোধহয় ভুল হচ্ছে। এটা হয়তো কুকুরের ছানাই হবে। তখন সে সেই বাচ্ছাটাকে নামিয়ে রেখে চলে গেল। পেছন থেকে ফলো করা বাটপাড়েরা সেই ছাগল ছানাটাকে তুলে নিয়ে কেটে পড়লো।
মাইকের আওয়াজ শুনে আমজাদুল হক সম্বিত ফিরে পান। একটু পর শুভেচ্ছা বক্তব্য দেয়ার জন্য তার নাম ঘোষণা করা হবে। তার মনে হচ্ছে আজ যদি তার জায়গায় শিবচরণ বাবু থাকতেন তাহলে তিনি তার শুভেচ্ছা বক্তব্যে ছাগল ছানা কুকুর ছানা হয়ে যাওয়ার গল্পটা বলতেন, কিন্তু তিনি পারবেন না। কারণ শিবচরণ বাবুর সাথে তার বা তাদের পার্থক্যটা এখানেই। মাইক হাতে নিয়ে অন্যদের মত তিনিও শিবচরণ বাবুকে স্বাস্থ্যের প্রতি যত্ন নিতে বলবেন, এবং তার সুস্থতা কামনা করবেন।